ট্রেনে শিয়ালদহ থেকে, সোনারপুরের পরের স্টেশনই হল সুভাষগ্রাম; আগে নাম ছিল চ্যাঙড়িপোতা, পরে নাম বদলে হয় সুভাষগ্রাম। ১ নং প্লাটফর্ম থেকে বাঁদিকে দেড় থেকে দু কিলোমিটারের মত রাস্তা গেলেই পড়ে – কোদালিয়া। হ্যাঁ, সেই কোদালিয়া; যেখানে নেতাজী সুভাষ বসুর পৈত্রিক ভিটে রয়েছে; আছে চারশো বছরেরও বেশী প্রাচীন দুর্গা দালান, গ্রন্থাগার ইত্যাদি; সম্প্রতি সরকারি ভাবে বাড়িটিকে তার পূর্বাবস্থায় সংরক্ষিতও করা হয়েছে। কোভিডের আগে, এক ২৩শে জানুয়ারির দিন তাই কোদালিয়ায় উপস্থিত হই। প্রসঙ্গত এই কোদালিয়ার সঙ্গে আরও অনেক বিখ্যাত লোকের নাম জড়িয়ে আছে, যেমন শিবনাথ শাস্ত্রী, মানবেন্দ্র নাথ রায়, রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার প্রমুখ; তাই একটু সম্ভ্রম তো ছিলই। কিন্তু এখানে এসে যাকে আবিষ্কার করলাম, তাতে বিস্ময়াবিষ্ট না হয়ে পারিনি। কিছুতেই যেন তার ঘোর কাটতে চাইছিল না। সেই বিস্ময়ের ভার খানিক লঘু করার ইচ্ছাতেই আজ এই লেখার অবতারনা।
ষ্টেশন থেকে কোদালিয়া যাওয়ার রাস্তায়, দুদিকেই সব পুরনো পুরনো বাড়ি, কেমন যেন শ্যাওলা ধরা রং, বাড়িগুলির সামনে পেছনে অনেকটা করে ফাঁকা জায়গা, বড় বড় গাছ পুকুর; সর্বোপরি গাছের ছায়ায়, রাস্তায় তেমন করে রোদ পড়তে পারে না, তাই বেশ ছায়াশীতল।
সুভাষ বসু বেশ কয়েকবার কোদালিয়ায় এসেছেন, জানকীনাথ বসুর অনেক শরিকেরা এখনও এখানে থাকেন। পাকা খড়ে ছাওয়া চার চালার দুর্গা দালানে, এখনও ফি বছর দুর্গা পুজা হয়। দালানের সামনেই বাঁদিকে দোতলা বাড়িতে, জানকীনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি রয়েছে। ছুটির দিন, তাই লাইব্রেরি বন্ধ। দেওয়ালের গায়ে দেখলাম, একটি শ্বেত পাথরের ফলক; তাতে বিভিন্ন সময়ে যারা এই গ্রন্থাগারের জন্যে অর্থ সাহায্য করেছেন তাঁদের নাম; বিস্ময়ের শুরু এখান থেকেই। কারণ সর্বাগ্রে দেখলাম অভিনেতা রাজ কাপুরের নাম –নামের পাশে তাঁর দান কৃত অর্থ রাশির পরিমান উল্লেখ করা আছে ৫০০০ টাকা।
বসুরা আগে সাধুখাঁ ছিলেন। ওদের বাড়ির পেছনেই একটা খেলার মাঠ রয়েছে। মাঠের ডান দিকে সরু পিচ রাস্তা ধরে হেঁটে, সামনের মোড়টায় এসে দাঁড়িয়েছি টো টো বা প্যাডেল রিক্সা কিছু ধরবো বলে, নজরে পড়লো একটা স্ট্যাচু, আবক্ষ। সামনে দিয়ে চলে গেছে, রাজপুর গামী পিচ রাস্তাটি কার্যত শুনশান। লোকজন তেমন নেই। মাঝে মাঝে টো টো গুলো যাওয়া আসা করছে শুধু। উৎসাহিত হয়ে কাছে গিয়ে দেখলাম, নীচের কালো ফলকে লেখা আছে সলিল চৌধুরীর নাম। হ্যাঁ, সেই সলিল চৌধুরী। ‘মধুমতী’ ‘দো বিঘা জমিন’ এর অমর সুরকার সলিল চৌধুরী, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’র সুর স্রষ্টা সলিল চৌধুরী, লতা মঙ্গেশকরকে সর্বপ্রথম কোনো মালয়লাম ছবিতে গান গাইয়ে নেওয়া সলিল চৌধুরী, আই পি টি এ, গণনাট্য, কমিউনিস্ট আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া সলিল চৌধুরী, বম্বে ইয়ুথ ক্যয়ারের প্রতিষ্ঠাতা সলিল চৌধুরী। লতার গাওয়া পূজা সংখ্যার সেই কালজয়ী গান গুলোর চিরস্মরণীয় গীতিকার এবং সুরকার সলিল চৌধুরী। রাহুল দেব বর্মণ যাকে গুরু মানতেন, সেই সলিল চৌধুরী।
কিন্তু তিনি, এখানে! ঔৎসুক্য চেপে রাখতে না পেরে, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক বয়স্ক লোককে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন, “ আচ্ছা এখানে সলিল চৌধুরীর মূর্তি …কেন কি একটু বলবেন!”
“সে কি! জানেন না?” “সলিল চৌধুরী তো এখানেই বড় হয়েছেন।“
পাশের ঢালাই রাস্তাটার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, “এখানেই তো তাঁর মামার বাড়ি!” “কাছেই, যান না, ঘুরে আসুন।“
কেমন শিহরিত হই। এটাই সেই রাস্তা, সলিল চৌধুরী যেটা ধরে রোজ হেঁটে যেতেন…! হয়তো তখন মাটির রাস্তা ছিল। কৈশোর, যৌবনের দিনগুলোয় কেমন ছিল তাঁর পদচারনার ছন্দ, নানা প্রশ্ন, ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। দেখি সামনেই পাড়ার মহিলারা জটলা করে নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন; শীতের রোদ সম্ভবত তাদের রাস্তায় টেনে এনেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, সলিল চৌধুরীর মামার বাড়িটা ঠিক কোনটা, বলতে পারবেন? একজন বয়স্ক মত মহিলা ঠোঁট বিদড়ে বললেন, “পুরনো বাড়ির আর কিছু নেই। সব ভাঙা!”
“এখন কেউ থাকেন না এখানে?”
প্রশ্ন শুনে, এ ওর দিকে তাকিয়ে, মুখ টিপে টিপে হাঁসতে লাগলেন।
“ওই তো, একজন মামাতো ভাই থাকে।" রাস্তার উল্টো দিকের একটা একতালা বাড়ির দিকে হাত তুলে দেখালেন একজন প্রৌঢ়া। “একটু কথা বলা যাবে?” “এই…গিয়ে দেখ তো, বল্ একজন কথা বলবেন দাঁড়িয়ে আছেন।"
পৌষের অপরাহ্ন, দেখি বিদ্যাসাগরীয় ধাঁচে, দু কাঁধে দুটো শালের খুট জড়িয়ে, একজন ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। শ্যামলা রং, নাকের নীচে সরু গোঁফের রেখা; যেন সলিল চৌধুরীর ট্রু কপি। পরনে লুঙ্গি। কল তোলা হাসি হেঁসে বললেন, “বলুন, কি জানতে চান!” “আপনি…।!” “হ্যাঁ, সলিল চৌধুরী, আমার পিসতুতো দাদা!” “পিসেমশাই, আসামে লটাবাড়িতে চা বাগানের ডাক্তার ছিলেন!” “হ্যাঁ, জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী”
১৯২৫ শে জন্ম, শৈশব সেখানেই কেটেছে, এখানে এসেছিলেন তারপরে, এসব জানা আছে! "আপনি বরং আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে সলিল চৌধুরীকে কিভাবে দেখেছেন সেটা বলুন!”
“আমি তখন খুবই ছোট, স্কুলে পড়ি। হরিনাভি হাই স্কুলের ছাত্র আমি। সলিলদাও একই স্কুল্ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছেন।“
“অনেক লোকজন এখানে উনার সঙ্গে আসতেন। কমিউনিস্ট পার্টি ব্যান হলে, আমাদের বাড়িতেই বেশ কিছু দিন আত্মগোপন করে ছিলেন।" "সাথে আরোও কয়েকজন ছিল।" “পরে শুনেছি, গণনাট্য সংঘের লোকজন ছিলেন ওরা।“
“তা, একদিন আমার ওপরে ডাব পাড়ার ভার পড়লো।“
“গাছে উঠতে পারতেন আপনি?”
“হ্যাঁ, ডাব পেড়ে খাইয়েছি।" “প্রায়শই, রাত করে বাড়ি ফিরতেন; যাত্রা থাকতো; অনেকেই জানেন না, যাত্রা গানের সুরও করেছেন, সলিলদা”!
“তবে, আজ এসেছেন যখন, চলুন পুকুর ঘাটটা একটু দেখিয়ে আনি আপনাকে!” “কেন, পুকুর ঘাট কেন?”
“এককালে, বম্বের রাজ কাপুর, নার্গিস এসে এই পুকুরে ছিপ ফেলেছিলেন। চানও করেছিলেন নার্গিস,” পেছনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আমাকে এই সব বলছিলেন ভদ্রলোক। দেখে, ঘাটটাকে পোড়ো বলেই মনে হয়। লতাপাতা, ঝোপ ঝাড়ে কেমন বুনো ভাব। পলেস্তারা খসে ধাপের ইটগুলো বিচ্ছিরি ভাবে বেরিয়ে পড়েছে, কেমন ক্ষয়াটে নোনা ধরা। পুকুরটিও পানায় ভর্তি। বোঝা গেল, সংস্কার হয়নি দীর্ঘদিন।
ঘাটটাকে দেখলে, এককথায় জীবনানন্দীয় মায়া লেগে আছে বলে মনে হবে।
ফিরে আসার সময়ে, ভদ্রলোক আমাকে তাঁর ফোন নম্বর দিলেন, নাম বললেন অচিন রায়।
“আজি হতে শতবর্ষ পরে…”, সলিল চৌধুরীর জন্ম শতবর্ষে (১৯ শে নভেম্বর ১৯২৫ থেকে ১৯ শে নভেম্বর, ২০২৫) ফের একবার তাঁর কোদালিয়ার মাতুলালয়ে টুঁ মারতে পৌছালাম; উদ্দেশ্য ছিল, মামার বাড়িতে বড় হওয়া ছেলেটিকে কিভাবে তার এলাকার মানুষজন মনে রেখেছে, সেটা দেখার। প্রথমবার যাওয়ার পাঁচ বছর পরে গেলাম । গিয়ে দেখি শুধু স্ট্যাচুটাই রয়েছে অপরিবর্তিত, পেছনে আবার একটা সেলুন হয়েছে, নতুন। জন্মদিনে, সকালে হয়তো কেউ মালা পরিয়ে গেছে। দুই গাছা রজনীগন্ধার ফুলের মালা ঝুলছে, স্ট্যাচুর গলায়। ব্যাস। মঞ্চ বাঁধা হয়নি, তার স্মৃতিতে কারোর কোনো আগ্রহ চোখে পড়লো না। যথারীতি, অচিন রায়ের বাড়ি যাব বলে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে জায়গাটার পুরো ল্যান্ডস্কেপ বদলে গেছে। অনেক নতুন বাড়ি উঠেছে, রাস্তার মুখে লোহার গেট গুলো গতি রুদ্ধ করে দিয়েছে। মনে হল এই বাড়িটা হতে পারে অচিন বাবুর বাড়ি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ইতিমধ্যে অচিন বাবুর ফোন নাম্বার আমার ফোন থেকে অন্তর্হিত হয়েছে। অগত্যা, বাড়ির বাইরে এক ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এটাই কি সলিল চৌধুরীর মামার বাড়ি? ভদ্রমহিলা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, কে সলিল বলুনতো। আমি নতুন ভাড়ায় এসেছি তো, ঠিক বলতে পারবো না।
তবু আশা ছাড়তে পারি না। সেই পুকুরটাকে খোঁজার চেষ্টা করি। কোনোরকম উলটোদিকের পাড়ে পৌছতে পারি, দূর থেকে দেখি ঘাটটাকে। আরও ভেঙ্গে পড়েছে। যদিও সবটা এখনও হারিয়ে যায়নি। কিছু স্মৃতি এখনও বেঁচে আছে।
আমার কাছ ঘেঁষে এক বয়স্ক লোক এসে বললেন, এই যে নারকেল গাছের গোড়ায় - ভাঙা শানটা দেখছেন, এইখানে বসে সলিল চৌধুরী বাঁশি বাজাতেন। আড় বাঁশি। রাজপুরের দক্ষিণ পাড়ায় বাড়ি, জ্যোতি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রেমও কোদালিয়ায় থাকতে থাকতে।
ভারতবর্ষের ফিল্ম সঙ্গীতের ইতিহাসে যাকে দেশীয় লোক সঙ্গীত এবং পশ্চিমী সুরের প্রথম সফল ফিউসন কারিগর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, ভাবলে গা শিউরে ওঠে তাঁর বাজানো বাঁশির সুরেই এককালে আন্দোলিত হত এখানকার হাওয়া বাতাস। কে জানে, সেই সুরে তাঁর প্রথম প্রেমের প্রতিভাস ফুটে উঠতো কিনা।
যার পায়ের কাছে বসে গান শিখতেন স্বয়ং কিশোর কুমার, ,সেই সলিল চৌধুরীর জন্ম শতবর্ষে আরোও একটু স্মৃতিযাপনের উত্তাপ কি প্রয়োজন ছিল না! অন্তত কোদালিয়ার মাতুলালয়ে!




মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন