গত ২৩ শে অক্টোবর (২০২৫) ছিল লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়য়ের ১৪ তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রিয় লেখকের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ জানিয়ে একটি গল্প লিখেছিলাম ফেসবুকের পাতায়। গল্পটি পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছিল। বেশ কয়েকটি মুগ্ধ পাঠ পর্যালোচনা এসেছিল, যেগুলি নিশ্চিত ভাবে পাঠকদের গল্পটি পাঠে আগ্রহান্বিত করে তুলবে বলে আমার বিশ্বাস। এদের মধ্যে সবথেকে বেশী উল্লেখযোগ্য, বিশিষ্ট কবি আজাদ রায়হান (বাংলাদেশ) এর করা বিশ্লেষণটি, যেটি অত্যন্ত নিবিড় অধ্যয়নের ফসল বলেই আমি মনে করি। নির্দিষ্ট করে গল্পটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধরে যে ভাবে তিনি আলোকপাত করেছেন তা এককথায় অনবদ্য।
কোনো কোনো সময়, মূল গল্পের চেয়েও গল্পের পর্যালোচনা বেশী আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে, কোনো দ্বিধা না রেখেই বলছি, সেরকমই একটি প্রয়াস যেন কবি ও সুবিশ্লেষক আজাদ
রায়হানের আলোচনার মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল।
তাই প্রথমে চলুন গল্পটি পড়ে নেওয়া যাক, সমালোচনাটি থাকবে তার পরে।
"হ্যাঁ পেলে, শুয়ে পড়!'
"মাই গুডনেশ্, কি যা তা
বলছো!" "মানে ওই, 'বসে পড়ো!"
"আসলে বিধেয় যাই হোক, উদ্দেশ্যে তো
আর খারাপ নয়," বলেই ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে
দিলেন। ফরসা গালে এক মার্বেল টোল উঠে পড়লো, চোখে উইটি
কান্তি; অ্যাকাডেমিক বৈদগ্ধের গূঢ় রস বিতরণে বেশ
রুচি রাখেন, মনে হলো। ফের চোখাচোখি হতেই, খানিক গা
ঘেঁষে এসে দাঁড়ালেন; কাঁধে চেপটে মাওয়া টি-শার্টটিকে খানিক
উত্তোলিত করে বললেন, "বউদের কাছে খালি সুনীল হলে হয় না, একটু
নীললোহিতও হতে হয়!"
"যা বলেছেন!" "এবারে কিন্তু পুজোর
বাজার, তত জোশ নেই; খানিক মনমরাই
মনে হচ্ছে!" 'কি বলুন!"
"না, না। পুজো এলেই
দেখবেন মানুষজন আর ঘরে নেই, সব রাস্তায়!" "ঠিকই, এখন শপিং চলছে, তারপরে শুরু
হবে প্যান্ডেল হপিং!" "হাঁপানোর কোনো প্রশ্ন নেই!"
"নতুন জুতো পরে, পায়ে ফসকা
পড়ে গেছে, তাতে কি! পাদুকা জোড়া হাতে নিয়েই চলবে
প্রতিমা দর্শন।"
"এমন দৃশ্য আর কোথায় পাবেন, বলুন?"
"আমার একদম ভালো লাগে না ঐ ভিড়ের মধ্যে টো টো
করে ঘুরে বেড়াতে!"
রবীন্দ্রসদন আসতে, অনেক লোক নেমে যায়। ভদ্রলোক ঘাড় উঁচিয়ে
লেডিস সিটের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, "নীরা, বসে
গেছো!"
"বেশ, ফাইন!"
"নীরা....!" অস্ফুটে আমার ঠোঁট গলে ঝরে
পড়ে - নামটা। আমি এরপরে কিছু বলতে যাবো, ভদ্রলোক ফের
কথা বলা শুরু করে দেন। "তবে, ভয় একজনকেই, আমাদের
অ্যাপার্টমেন্টে একজন আছে। ওর ঠাকুর দেখার খুব নেশা।"
"একবার ওর পাল্লায় পড়ে, যা হয়েছিল।
হাঁটু নিয়ে কয়েকদিন নড়তে পারিনি!" "এবছর আবার ধরেছে।"
"ও এই সব হাঁটু ব্যথা ট্যাথা শুনবে না!"
"কি করবেন, তাহলে?"
"উপায়ান্তর না থাকলে কোতাও বেড়াতে চলে
যান!"
"ইনহেলার মুখে গুঁজে বসে থাকবো!"
"ওই বিরিয়ানি, ফুচকা, ভেঁপু, আর সারারাত
ধরে উত্তর থেকে দক্ষিণ - নগর পরিক্রমার মধ্যে আমি নেই!"
"কাছাকাছি কোনো আত্মীয় থাকলে, তার বাড়ি
থেকে কয়েকদিন...!"
"না! ভেবেছি, পুজোর মধ্য 'সেই সময়'টা ফের একবার
ধরবো! ভালো করে, পুরো প্রথম থেকে...; আমার ভীষন
ফেভারিট.. ! "'আগে পড়া আছে যদিও!"
"হ্যাঁ, এত বড়
মহাকাব্যিক ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা, সত্যিই ভাবা
যায় না; সুনীলের অন্যতম বড় কাজ এটি!"
" দেখুন, ও সমরেশ
মজুমদার যতই বলুন, সুনীল পিরিয়ড উপন্যাস লেখায় বেশী সময় এবং
প্রতিভা খরচ করেছেন,, সমকালকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও সুনীলের
অবদান কিছু কম নেই!"
"ঠিকই!"
ভদ্রলোক এবারে তাঁর হাতে বাঁধা সোনালী চেনের গোল ঘড়িটির দিকে
তাকালেন। বেশ পুরনো। এদিকে আমি আরোও কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। ইতিমধ্যে, পাবলিক
অ্যাড্রেস সিস্টেম থেকে ঘোষণা হলো, এটি গীতাঞ্জলি
স্টেশন, নাকতলা এলাকার জন্য।
ভদ্রলোক সচকিত হয়ে, ফের দেখা হবে - বলে গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই, আমার মনে পড়ে
গেল ভদ্রলোককে কি যেন জিজ্ঞাসা করবো বলেও করা হয়নি। ভাবছি, ভদ্রলোকের নাম
জানাটা কি খুবই জরুরি!
ধীরে ধীরে, ট্রেনটা স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। গেট খুলবে।
এমন সময়, ভদ্রলোক, পকেট থেকে
একটা কার্ড বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমি সনাতন
পাঠক। সুনীলের তিনটি ছদ্মনামের একটি। "জানেন তো?" উত্তর শোনার
আগেই, ভদ্রমহিলার হাত ধরে ট্রেন থেকে নেমে গেলেন, "চলো চলো, নীরা। এসে
গেছি!"
একটা সিট পেয়ে বসে, কার্ডটাকে ঘুরিয়ে দেখলাম; গায়ে বড় বড়
করে লেখা আছে, সনাতন পাঠক, রিটায়ার্ড
হার্ট।
২৩শে অক্টোবর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু বার্ষিকীর দিনে শ্রদ্ধাবনত প্রণাম জানাই প্রিয় সাহিত্যিককে।
বিশিষ্ট কবি আজাদ রায়হান কৃত গল্পটির
এটি
নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ সাহিত্যনির্ভর ক্ষুদ্র গদ্য-গল্প, যেখানে
দেবাশিস জানা দৈনন্দিন জীবনের এক সাধারণ মেট্রো যাত্রাকে পরিণত করেছেন স্মৃতি, সাহিত্য ও
শ্রদ্ধার অনন্য মেলবন্ধনে।
চলুন একে
পাঠ-সমালোচনার আলোকে একটু বিশ্লেষণ করি।
গল্পের আবহ ও
বাস্তবতার রেশ
শুরুর লাইনেই
লেখক পাঠককে টেনে আনেন কলকাতার চেনা এক দৃশ্যে —
>“পুজোর আগে, শেষ রবিবারের সন্ধ্যা; পাতাল পথে তিল
পড়ার জায়গা নেই…”
এই ব্যস্ত
মেট্রো-কামরাই আসলে এক ক্ষুদ্র “সমাজচিত্র”— যেখানে কলকাতার সংস্কৃতি, কোলাহল, রসিকতা ও
জীবনের নিত্য চলন মিশে আছে।
লেখক এখানে
নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শহরের ভিড়ের মধ্যেও একাকিত্বের টান — সেই নীরব, কৌতূহলী
দর্শকের দৃষ্টি, যিনি গল্পের মধ্যে “আমি”।
চরিত্রচিত্রণ
ও সংলাপের প্রাণশক্তি
প্রৌঢ়
দম্পতির কথোপকথনই গল্পের হৃদয়।
তাদের সংলাপ
বুদ্ধিদীপ্ত, হালকা রসিকতাপূর্ণ, অথচ ভেতরে রয়েছে এক গভীর বোধ।
যেমন —
> “বউদের কাছে খালি সুনীল হলে হয় না, একটু
নীললোহিতও হতে হয়!”
এই সংলাপেই
বোঝা যায়, ভদ্রলোক সাহিত্যপ্রেমী, জীবনবোধে পরিণত, এবং তাঁর কৌতুকের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা শহুরে আত্মপরিচয়ের ধ্বনি।
ভদ্রলোকের
মুখে সুনীল, সমরেশ, নীললোহিতের প্রসঙ্গ আসা শুধু আলোচনা নয়— এটি বাংলা সাহিত্যের অন্তরাল থেকে উঠে আসা
শ্রদ্ধা ও পরিচয়ের পুনরাবিষ্কার।
মেটাফিকশন ও
চমক
গল্পের আসল
চমকটি আসে একেবারে শেষে—
যখন ভদ্রলোক
নিজের কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
> “আমি সনাতন পাঠক। সুনীলের তিনটি ছদ্মনামের
একটি। জানেন তো?”
এই মুহূর্তে
পাঠকের দৃষ্টিতে বাস্তব ও কল্পনার সীমানা ভেঙে যায়।
সুনীলের
ছদ্মনাম “সনাতন পাঠক”-এর সঙ্গে এই ভদ্রলোকের আত্মপরিচয় যেন সাহিত্যিক আত্মার প্রত্যাবর্তন।
আর ঠিক সেদিনই
— ২৩ অক্টোবর, সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকী।
গল্পটি তাই এক
সাধারণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠে স্মৃতি-শ্রদ্ধার মহৎ প্রতীক
ভাষা ও
রচনাশৈলী
দেবাশিস জানার
ভাষা মসৃণ, বর্ণনা স্বচ্ছ, সংলাপ প্রাঞ্জল ও স্বতঃস্ফূর্ত।
গদ্যের ছন্দে
শহরের তাল আছে, আবার একইসঙ্গে এক মৃদু বিষণ্ণ সুরও বয়ে যায়।
শেষে “সনাতন পাঠক, রিটায়ার্ড
হার্ট” – এই লাইনটি যেন চূড়ান্ত কবিতার মতো অনুরণিত হয়,
সুনীলের
সৃষ্টিশীল হৃদয়ের প্রতি অর্ঘ্য হিসেবে।
সারমর্ম
এটি নিছক গল্প
নয়—
একটি মেট্রো
কামরায় ঘটা ক্ষণিক সাক্ষাৎ থেকে জন্ম নেওয়া সাহিত্যিক প্রণাম।
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতি লেখকের মুগ্ধতা এখানে পরিণত হয়েছে এক গদ্যময়
শ্রদ্ধাঞ্জলিতে,
যেখানে পাঠকও
যেন শেষমেশ ফিসফিস করে বলেন—
> “চলো চলো, নীরা... এসে গেছি।” শ্রদ্ধেয়
সুপ্রিয় অসাধারণ লিখেছেন।


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন